প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু ও শেষ | World War 1 Facts in Bangla

World War 1 Arts

প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যের পতন, একাধিক নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় কিংবা সাত কোটি সেনার অংশগ্রহণের মতো আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনার সম্মিলন ঘটেছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (World War I)-এ। এই বিশ্বযুদ্ধের মত ভয়াবহতা ও ধ্বংসযজ্ঞ বিশ্ববাসি এর অতীতে কখনো প্রত্যক্ষ করেনি। মানব ইতিহাসের অন্যতম কলঙ্কজনক অধ্যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরু ও শেষ নিয়েই থাকছে আমাদের আজকের আয়োজন। 

১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই অস্ট্রিয়ার যুবরাজ আর্চডুক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দ (Archduke Franz Ferdinand) এর হত্যার মধ্যদিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (World War I)-এর সূচনা হয়। যুবরাজের হত্যাকারী বসনিও সার্ভ জাতিগোষ্ঠীর হওয়ায় অস্ট্রিয়া তখন সার্বিয়া (Serbia) আক্রমণ করে। যুবরাজ ফার্দিনান্দের হত্যার মধ্য দিয়ে যুদ্ধ শুরু হলেও মূলত প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হবার বীজ রোপন করা হয়েছিল আরও বহু বছর আগেই।

সে সময় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত জটিল ও গোপনীয়তায় ভরা। ফ্রান্সের সাথে ঐতিহাসিক শত্রুতার কারণে বৃটেনের জার্মানির সাথে বন্ধুভাবাপন্ন সম্পর্ক ছিল, কিন্তু পরবর্তীতে জার্মানি ব্রিটেন-এর সাথে নৌ প্রযুক্তিতে পাল্লা দিতে শুরু করায় সম্পর্কটি হয়ে উঠে প্রতিযোগিতামূলক। অন্যদিকে ফ্রাঙ্কো-প্রুশিয়ান (Franco-Prussian) যুদ্ধের পর থেকে জার্মান ও ফ্রান্স এর মধ্যকার সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে, ফলস্বরূপ ফ্রান্স রাশিয়ার সাথে মৈত্রী করে। অন্যদিকে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরিয় সাম্রাজ্য রাশিয়াকে হুমকি হিসেবে দেখার কারণে জার্মানির সাথে মৈত্রী চুক্তি করে। 

ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইউরোপের প্রধান পরাশক্তিগুলো রাজনৈতিক পরিধি সম্প্রসারণের পাশাপাশি সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে মনোযোগী হয়ে ওঠে। অবিশ্বাসের দোলাচলে এসময় পরাশক্তিদের কাছে ইউরোপ হয়ে ওঠে গোপন চুক্তির এক আঁতুড়ঘর। পরাশক্তিগুলোর মধ্যে পারস্পারিক সন্দেহ ও অবিশ্বাস থেকেই বিভিন্ন চুক্তি হতে থাকে, আর সে সব চুক্তিই প্রথম বিশ্ব যুদ্ধকে ত্বরান্বিত করে। 

১৮৭২ সালে রাশিয়া, জার্মানি ও অষ্ট্রিয়ার মধ্যে ত্রিশক্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, কিন্তু ১৮৭৮ সালের দিকে রাশিয়ার সাথে সম্পর্কের অবনতির কারণে চুক্তিটি কার্যকারিতা হারায়। এই চুক্তির কার্যকারিতা হারানোয় ১৮৮০ দশকে জার্মানি ও অষ্ট্রিয়ার মধ্যে নতুন চুক্তি স্বাক্ষর হয়। 

ঊনিশ শতকের শিল্প বিপ্লবের ফলে উৎপাদিত পণ্যের নতুন বাজার সৃষ্টি, কিংবা কাঁচামালের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার প্রয়াসে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানির মধ্যকার অর্থনৈতিক প্রতিযোগীতা সময়ের পরিক্রমায় সামরিক সংঘাতের দিকে মোড় নিতে থাকে। সে সময় ব্রিটেন, ফ্রান্স সহ ইউরোপীয় পরাশক্তিগুলো এশিয়া, আফ্রিকা সহ বিভিন্ন অঞ্চলে উপনিবেশিক শাসন শুরু করে। পরবর্তীতে সেসব উপনিবেশের কারণে পরাশক্তিগুলোর মধ্যে সম্পর্কের চরম অবনতি হয়। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাম্রাজ্যবাদ কিংবা উপনিবেশিকতা-কে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ হিসেবে আখ্যায়িত করা হলেও অনেক বিশ্লেষকের মতে ইউরোপে উগ্র জাতীয়তাবাদের বিকাশই মূলত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম প্রভাবক বলে তারা মনে করেন। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে ইউরোপের জাতীয়তাবাদের ধারণা এতটাই প্রবল হয়ে ওঠে, যার ফলে কোন সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেয়ে শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে সমাধান করাটাই অধিক গৌরবের মনে করা হতো, তাই পরাশক্তি দেশগুলোর উগ্র জাতীয়তাবাদী ধারণা ও আগ্রাসী মনোভাবই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। 

ঊনিশ শতকে জার্মানির প্রচ্ছন্ন সমর্থনে, অস্ট্রিয়ার সার্বিয়া আক্রমণ করার মধ্যদিয়ে যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে। সেখানে পরাশক্তিগুলো দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে, তা মহাযুদ্ধে পরিণত হয়। 

এরপর টানা ৪ বছর ৩ মাস ২ সপ্তাহ ব্যাপী বিশ্বজুরে যুদ্ধের ডামাডোল ছড়িয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মধ্যদিয়ে ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর এই যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের একদিকে ছিল অষ্ট্রিয়া, জার্মানি, হাঙ্গেরি ও বুলগেরিয়া, যারা মূলত কেন্দ্রীয় শক্তি হিসেবে পরিচিত ছিল। অন্যদিকে মিত্রশক্তি বলা হয় সার্বিয়া, রাশিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইতালির জোটকে। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে ব্রিটেন, ফ্রান্স-কে রসদ সরবরাহের অভিযোগে জার্মানি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৭টি জাহাজ ডুবিয়ে দেয়, এর প্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বযুদ্ধে যোগ দিলে জার্মানি তথা অক্ষশক্তির পরাজয় প্রায় নিশ্চিত হয়ে পড়ে। চার বছর স্থায়ী এই যুদ্ধে মিত্র শক্তির কাছে কেন্দ্রীয় শক্তির পরাজয়ের মধ্যদিয়ে সভ্য-অসভ্য নৃশংসতম প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। দীর্ঘ ৪ বছর স্থায়ী এই যুদ্ধে, প্রায় দেড় কোটি মানুষ প্রাণ হারায় এবং দুই কোটি মানুষ আহত হয়। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবেই প্রায় ১৮৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ও পরোক্ষভাবে প্রায় ১৫১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ হয়। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে সুদূরপ্রসারি প্রভাব রেখেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলে জার্মান, অটোমান, হাঙ্গেরি ও রোমান সাম্রাজ্যের মতো ব্রিহৎ ৪টি সাম্রাজ্যের পতন হয়। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অটোমান সাম্রাজ্যের অধিকাংশ আরব এলাকা, ফ্রান্স ও ব্রিটেন তাদের নিজেদের অধীনে নিয়ে আসে। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করে জাতিপুঞ্জের মত বিশ্বশান্তি সংস্থা গড়ে তোলা হয়। এই সংস্থাটি পরবর্তীতে কার্যকারিতা হারালেও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এটিই ছিল বিশ্বব্যাপী প্রথম সামষ্টিক কোন উদ্যোগ। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জয়লাভ করার ফলে মিত্র শক্তি, পরাজিত জার্মানি সহ অন্যান্য দেশগুলোর কাছ থেকে বিভিন্ন অযৌক্তিক সুবিধা আদায় করতে থাকে। এসময় মিত্রশক্তির দেশগুলো এক প্রকার জোর পূর্বক ভাবেই পরাজিত কেন্দ্রীয় শক্তির দেশগুলোর সাথে ত্রিয়ানো চুক্তি, সেভার্স চুক্তি ও অস্ট্রিয়ার শান্তি চুক্তির মতো বেশকিছু চুক্তি স্বাক্ষর করে, আর এই চুক্তি গুলোর অধিকাংশই ছিল একপক্ষিয় ও অসম্মানের। 

প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল ও আফ্রিকায় জার্মান কলোনি সমূহ ব্রিটেন, ফ্রান্স, জাপান সহ মিত্রশক্তির কিছু দেশ কুক্ষিগত করার পাশাপাশি জার্মানিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য যুদ্ধাপরাধী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এমনকি জার্মানির কাছ থেকে অযৌক্তিকভাবে যুদ্ধের ক্ষতিপূরণও আদায় করা হয়। জার্মানির উপর চাপিয়ে দেয়া এসব সর্ত জার্মানদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করে, আর এই ক্ষোভ ধীরে ধীরে জার্মান জাতীয়তাবাদকে শক্তিশালী ও বিস্তৃত করে তোলে। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ যেমন হিটলার বা মুসোলিনির মতো একনায়কদের ক্ষমতায় আসার পথ তৈরি করেছে, ঠিক তেমনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তৈরীর পথকেও প্রশস্ত করেছে, আর তাই প্রায় সকল বিশ্লেষকই এক বাক্যে স্বীকার করেন যে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মধ্যেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীজ নিহিত ছিল।

আমাদের আজকের পোষ্টটি আপনার কেমন লাগলো তা আমাদের জানাতে ভুলবেন না, আর পোষ্টটি ভাল লাগলে অবশ্যই আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, ধন্যবাদ।

No comments:

Powered by Blogger.